জহির ভূইয়া,
বার্তা২৪ ঢাকা, ২২ মার্চ:
দিনের হাসি কান্নায় রূপ নিলো রাতে। পারলো না বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র দুই রানে হেরে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি স্বাগতিকরা।
মিরপুরের পঞ্চম উইকেট, আর সময় রাত ১০টা ১৫ মিনিট। ২৪ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে স্টেডিয়ামে, আর প্রেসিডেন্ট বক্সে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, হসপিটালিটি বক্সে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদ সকলেই অপেক্ষার প্রহর গুণছেন সেই মুহূর্তটির।
১২ বলে ১৯, ৯ বলে ১৩, ৯ বলে ৬, ৬ বলে ৯, ৪ বলে ৭ রান দরকার জয়ের জন্য। হাতে আছে দুটি উইকেট। উত্তেজনায় কাঁপছে মিরপুরের স্টেডিয়ামের গ্যালারি। শেষদিকে ১ বলে ৪ রান হলে জয়! ১ বলে ১ রান আসে রিয়াদের ব্যাট থেকে। হেরে গেল বাংলাদেশ ২ রানে! হল না এশিয়া কাপ জয় করা। অধরা থেকে গেল এশিয়া কাপ। এতো কাছে গিয়ে ফিরে আসায় কষ্টটা বুঝি মুশফিকদের বেশি হয়েছে। তাই মাঠে কাঁদছিলেন মুশফিক। কান্নারই তো কথা। দর্শকই কেঁদেছে আর মুশফিক তো . . . ।
বাংলাদেশ ২৩৪ রান স্পর্শ করলেও বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন ইতিহাসের জন্ম হল না। এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ২২ মার্চ স্মরণীয় একটি দিন হতে পারত। মিসবাদের দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবার মিশন ব্যর্থ অল্পের জন্য। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যতো বার এশিয়া কাপ আয়োজন হবে ততোবারই মিরপুরের উইকেটে পাকিস্তান, ভারত আর শ্রীলঙ্কাকে তুলধুনো করে বাংলাদেশের শিরোপার কাছাকাছি যাবার ঘটনা উচ্চারিত হবে।
দুর্দমনীয় বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে হার না মানা একটি দলের নাম হতে পারত। ওয়েলডান বাংলাদেশ, সাবাস বাংলাদেশ আর টাইগারদের এগিয়ে চলা-এ শব্দ এখন আর মুশফিকের উচ্চতার সঙ্গে যেন খাপ খাচ্ছে না। এশিয়া কাপের আন্ডারডগ বাংলাদেশ জিতেছে শিরোপা! গ্রুপ ম্যাচে জেতা ম্যাচ এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই হেরেছে বাংলাদেশ ২১ রানে। তা না হলে ১৯৯৯ সালের পর পাকদের দ্বিতীয় বার হারানো স্বাদ গ্রহনের জন্য ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। পরের ম্যাচে ভারতকে ৫ উইকেটে, আর এরপর শ্রীলঙ্কাকে সেই ৫ উইকেটেই হারের স্বাদ বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ফাইনালে। সেই ফাইনালে বাংলাদেশের সামনে পরাশক্তি পাকিসত্মান ব্যাটিং, বোলিং কি ও ফিল্ডিং কোন বিভাগেই দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু পেসার শাহাদাতের ১৯ রানের খেসারত দিতে হল। মাঠে মুশফিক সাকিবকে জড়িয়ে ধরে সমানে কেঁদে চলেছেন। সাকিব, তামিম, নাসির সবার চোখেই পানি।
১৯৯৯ সালের সেই জয়ের পর এ যাবতকালে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের বলার মতো তো তেমন কোনো রেকর্ড নেই। না সেটা জয়ের, না সেটা উইকেট শিকারের বা সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের। ১৩ বছর পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে কিছু করেছে সেটা সরাসরি এশিয়া কাপের ফাইনালে! স্মরণীয়ই নয় অতিস্মরণীয় ঘটনা হবার কথা ছিল।
বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিসত্মানের এ যাবত কালে আজই সর্বনিন্ম স্কোরটা হল। ৯ উইকেট ২৩৬, এটাই এখন বাংলাদেশে বিপক্ষে নিম্ন স্কোর। এর মুল কারিগর ছিলেন মাশরাফি, নাজমুল, সাকিব আর রাজ্জাক। মিরপুরের উইকেটে আজ পেসার আর স্পিন যৌথভাবে আক্রমণ করেছে পাকদের। কোমর সোজা করে দীর্ঘ সময় ব্যাট করার সুযোগ পায়নি। ওপেনিং ১৬ রানেই ভেঙ্গে দিলেন মাশরাফি। আর ওয়ানডাউনে নামা অভিজ্ঞ ইউনুস খানকে এলবি’র ফাঁদে ফেলেন নাজমুল। সেই শুরু।
তারপরও তৃতীয় উইকেটে মিজবা আর ওপেনার হাফিজ ৩৬রান যোগ করে ব্যাটিং ধ্বস সামলাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মিসবাহ (১) শাহদাতের বলে নাসিরের থ্রোতে রান আউট হলে পাকদের বড় স্কোর গড়ার স্বপ্নে অন্ধকার নেমে আসে। সেই অন্ধকার আরও বেশিমাত্রায় বাড়তে থাকে চতুর্থ উইকেটে হাফিজ ব্যক্তিগত ৪০ রানে রাজ্জাকের বলে ক্যাচ দিলে। ৭০ রানে ৪ উইকেট! কিন্তু পঞ্চম উইকেটে ওমর আকমল আর হাম্মাদ জুটি যদি ৫৯ রান যোগ না করতেন তাহলে হয়তো পাকদের আজ আরো কম রানেই আটকানো যেত।
১২৯ রানে হাম্মাদ (৩০) আর ১৩৩ রানে ওমর আকমল (৩০) সাজঘরের পথে হাটা ধরলে পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমে তখন হিমশীতল বাতাস বয়ে চলেছে। হাম্মাদ সাকিবের বলে আর উমর আকমল রিয়াদের বলে ফেরত যান। ১৩৩ রানে ৬ উইকেটের পতনের পর আফ্রিদি আর সরফরাজ আহমেদ সপ্তম জুটিতে ৪৫ রান যোগ করে দলকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন। তবে আফ্রিদিকে ২২ বলে ৩২ রানে সাকিব নাসিরের হাতে ক্যাচে পরিণত না করলে স্কোর আরও বেড়ে যেত।
আফ্রিদি ফেরত যাবার পর সরফরাজ জুটি বাধেন ওমর গুলের সঙ্গে আর সাঈদ আজমলের সঙ্গে। এরা কেউ ৪ রানে বেশি যোগ করতে পারেনি। তবে ১০ উইকেটে সরফরাজ আর আইজাজ চিমা জুটি শেষ ওভারে শাহদাতের বলে ১৯ রান নিয়েই বেশি এগিয়ে যায়। ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৩৬ রান। অলআউট হয়নি পাকিস্তান এটাই হতে পারে তাদের বড় পাওয়া।
২৩৭ রানের টার্গেট তাড়া করতে নামা বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম আর নাজিম জুটি ৬৮ রান এনে দেন। তবে আজো নাজিম উদ্দিন বেশি দূর যেতে পারলেন না। নাজিম ১০ রানে ফেরত গেলেন আফ্রিদির বলে ক্যাচ দিয়ে। কিন্তু তামিম টিকে ছিলেন বীরদর্পে। ওয়ানডাউনে নামা জহুরুল ইসলাম কোনো রান যোগ করার আগেই সাজঘরের পথে হাটা ধরলেন সাঈদ আজমলের বলে ক্যাচ দিয়ে।
তামিম তখন ক্যারিয়ারের ২৩ম ফিফটি করার পথে। যা কিনা তামিমের নামের পাশে লেখা হবে টানা ৪ ম্যাচে ফিফটি। যা এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। অবশেষে তামিম ৪৮ বলে ৭টি চার দিয়ে ৫০ রান পূর্ণ করেন। ক্রিজে তামিমের পাশে নাসির হোসেন। এই জুটি যখন সেট হয়ে রানের গতি বাড়াতে শুরু করেন তখনই পেসার ওমর গুল আঘাত হানেন। ৬০ রান করা তামিম গুলের বলে ইউনুস খানের হাতে বন্দি হলে মিরপুরের দর্শক চুপ মেরে যায়। হারের আতংক পেয়ে বসে তখনই।
কিন্তু চতুর্থ উইকেটে নাসিরের সঙ্গী সেই সাকিব আল হাসান। যার টানা ৩ ম্যাচে স্কোর ৬৪, ৪৯, ৫৬। সেই সাকিব ৩ ম্যাচে ১৩৭ রান করা নাসিরের সঙ্গী করে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাবার মিশনে নেমে পড়েন। এই জুটি যখন আফ্রিদি, সাঈদ আজমল আর গুলকে মোকাবেলা করছে তখন ২৫ ওভারে স্কোর ৮৬। ১৫১ রান দরকার। নাসির-সাকিবের ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে তারাও যেন খানিকটা ভেঙ্গে পড়েছে।
তবে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে শক্ত হতে শুরু করে এই জুটি। এই জুটির টার্গেট ছিল উইকেট ধরে রেখে রানের গতি এগিয়ে নেয়া। সেটাই তারা করেছে। ৩০ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর যখন ১০০, তখন ম্যাচ টি২০-তে রূপ নিয়েছে। কারণ ২০ ওভারে ১২০ বলে দরকার ১৩৬ রান। ১৬ বলের ব্যবধানে। এক পর্যায়ে সাকিব ব্যক্তিগত ২৭ রানে আর নাসির ৭ রানে ব্যাট করছেন, সাকিব রান আউটের হাত থেকে বেঁচে গেলে বড় একটি বাধা পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। কারণ এই চতুর্থ জুটির উপরই বাংলাদেশের এশিয়া কাপ জয়ের মূল ভিত্তি নির্ভর করছিল।
নাসির একটু বেশি বল ব্যয় করলেও সাকিব তা পূরণের চেষ্টা করেন। ৩৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ১৩২। ওভার প্রতি রান দরকার ৭ করে। কঠিন তবে কোনভাবেই অসম্ভব নয়। ৩৭ ওভার শেষে পাকিস্তানের স্কোর ছিল ৬ উইকেটে ১৪৯, সেখানে বাংলাদেশের ৩ উইকেটে ১৪২। তুলনার বিচারে তো বাংলাদেশ এগিয়ে। এক পর্যায়ে ৬৩ বলে ৮৬ রান দরকার পড়ে। ২৩ বলের পার্থক্য। এক সময় মনে হয়েছে শাহাদাতের দেয়া এক ওভারে ১৯ রানের কারণেই কি হারবে বাংলাদেশ! সাকিব তখন ২৫ম ফিফটির দরজায় দাড়ানো (৪৬)।
গুলের বল মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারি মেরে সাকিব ২৫ম ফিফটি পূরণ করেন ৭৭ বলে ৬ বাউন্ডারি দিয়ে। নাসির ৫৮ বল খেলে ২৭ রানে ব্যাট করছেন। স্বপ্ন তখনই জীবন্ত ছিল, যদি একটি ওভার এই জুটি তেরেফুরে মারতে পারে তাহলেই তো হয়ে যায়! পরের ওভারে সাঈদ আজমলের প্রথম বলেই সাকিব ছক্কা মেরে তা শুরু করে দিলেন। মানে তেরেফুরে মার্ক ব্যাটিং। ৫৩ বলে ৭১ রান প্রয়োজন। ভারতের বিপক্ষে সেই জয়ের মুহূর্তেগুলো সামনে চলে আসে। সেদিন তো হয়েছিল। আজ কেন হবে না! হাতে তো ৭ উইকেট অক্ষত ছিল! ৬৩ বলে ২৮ রান করে ক্যাচ দিয়ে নাসির সাজঘরের পথে যখন হাটা ধরেন তখন বাংলাদেশ জয় থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে।
চার উইকেটে ১৭০ ওভার ৪২.৩ ওভারে। ক্রিজে সাকিবের সঙ্গে মুশাফিক। এরপর রিয়াদ, রাজ্জাক, মাশরাফির বাটিং বাকি ছিল। কিন্তু বল তো কমে গেছে! গুল আর সাঈদের বল ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে লাগাতেই কষ্ট হচ্ছিল। ৪০ বলে ৫৯ রান সাকিব-মুশফিকের জন্য কঠিন হবার তো কথা নয়। কিন্তু সাকিব (৬৮) বোল্ড হয়ে গেলেন আইজাজ চিমার বলে। স্তব্ধ পুরো স্টেডিয়াম। ক্রিজে অধিনায়ক মুশফিক আর সহ অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ৫ম জুটি। দরকার ৩০ বলে ৪৭ রান, ১৭ বলের ব্যবধান। পারবে কী মুশফিক-রিয়াদ জুটি! মুশফিক আইজাজ চিমার বলে বল আকাশে তুলে দিলেন ছক্কার আশায়। কিমত্ম বল বেশি উচুতে উঠে যায়। ফলাফল মুশফিক বন্দি হলেন নাসির জামসেদের হাতে। পুরো স্টেডিয়ামের দর্শক তখন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মনে হল শেষ আশার আলোটি বুঝি নিভে গেল। হল না বাংলাদেশের এশিয়া কাপের শিরোপা জয়।
যদিও বহুদিন পর দলের স্বার্থে মাশরাফি ব্যাটিং জ্বলকানি দেখাবার প্রয়োজন হল। কিন্তু মাশরাফি ঠিক মতো ব্যাটিং করতে পারছিলেন না। বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমে তখন থমথমে পরিবেশ। কারও মুখে কথা নেই। পারবে কি বাংলাদেশ ২৪ বলে ৩৯ রান সংগ্রহ করতে! আর এশিয়া কাপে রানে না থাকা রিয়াদেরও কিছু একটা করার সময় এসে গিয়ে ছিল। ২২ বলে ৩৪ অসম্ভব তো কিছু নয়। হাতে তো ৪ উইকেট ছিল। ৩টি বাউন্ডারি ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারে। এমন যখন পরিস্থিতি তখনই গুলের বলে ব্যাক সাইডে তুলে দিলেন বল মাশরাফি। বল বাউন্ডারির বাইরে। বলে আর রানে ব্যবধান কমেছে কিছুটা। মিরপুরের দর্শক জেঁগে উঠে। কারণ আবারো চার মারলেন মাশরাফি। এই ঝলকানিই তো দরকার ছিল ঐ মুহূর্তে। ৪৭ম ওভারে গুল দিলেন ১৪ রান। স্কোর ৪৭ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ২১২ রান। ১৯ বলে ২৫ রান দরকার। মাশরাফি ৬ বলে ১৩ রানে আর রিয়াদ ৯ বলে ৯ রানে ব্যাট করে আশা জাগিয়ে রেখেছেন।
শেষ দিকে ২৩৭ রানের টার্গেটের কাছাকাছি ২৩৩ রানে গিয়ে ২ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। কারণ ১ বলে দরকার ছিল ৪ রান। স্ট্রাইকে থাকা বোলার শাহদাতের পক্ষে বাউন্ডারি মারা সম্ভব হয়নি। হেরে গেলে বাংলাদেশ তারপরও মিরপুরে দর্শক বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চিৎকারে মুশফিকদের সান্ত্বনা দিয়েছে। বাংলাদেশ এশিয়ার দ্বিতীয় দল, এটাই কম কিসে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন